অন্তর্ভূক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে
আসন্ন বাজেট ঘোষণাকে সামনে রেখে ‘অন্তর্ভূক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে’ -এই দাবিতে আজ ৯ মে, ২০১৮, বুধবার, সকাল ১১.০০ মিনিটে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির গোল টেবিল মিলনায়তনে গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বেসরকারী নাগরিক সংগঠনের জোট সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান-সুপ্র। সুপ্র’র ভাইস চেয়ারপার্সন জনাব মঞ্জু রাণী প্রামাণিক -এর সভাপতিত্বে ও সুপ্র সাধারণ সম্পাদক জনাব এম এ কাদের -এর সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে সম্মেলন পত্র পাঠ করেন সুপ্র সচিবালয়ের প্রকল্প সমন্বয়কারী জনাব মো. আজমল হোসেন।
সুপ্র সাধারণ সম্পাদক জনাব এম এ কাদের এসডিজি বাস্তবায়ন সমন্ধে বলেন, আমাদের দেশীয় উৎস থেকে অর্থায়ন করতে হবে। এসডিজি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া জোর দেয়ার পাশাপাশি মনিটরিংএ গুরুত্ব দিতে হবে। সুপ্র এসডিজি’র ১,২,৩, ৪, ৫, ১০, ১৩, ১৬ ও ১৭ নম্বর লক্ষ্যসমূহ অর্জনে দেশব্যাপী তার প্রচারাভিযান শুরু থেকেই চালিয়ে আসছে। এসডিজি’র লক্ষ্যসমূহ অর্জনে খাতভিত্তিক বিশেষ বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
সুপ্র মনে করে, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হলে নানা ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। স্বল্প সুদের যেমন ঋণ পাওয়া যাবে না, তেমন এলডিসি হিসেবে প্রাপ্ত বাণিজ্য সুবিধাও কমে যাবে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এখনই একটি সমন্বিত পরিকল্পনা সরকারের হাতে নেয়া উচিৎ। এক্ষেত্রে আগামী ছয় বছর বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে সরকারের বেশী মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের উপর অধিকহারে করারোপ করা প্রসঙ্গে বক্তারা বলেন, তামাক এবং তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার বিশ্ব জুড়ে হৃদরোগ, ক্যান্সার, বক্ষব্যাধি এবং অন্যান্য অনেক রোগের এমনকি অপরিণত বয়সে সংঘটিত অধিকাংশ মৃত্যুরই অন্যতম কারণ। উল্লেখিত রোগসমূহের ক্ষেত্রে তামাক অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ একটি উপাদান। বিশ্বে বর্তমানে ৫ মিলিয়নের অধিক মানুষ তামাকজনিত অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে শতকরা ৪৩.৩ ভাগ মানুষ ধোঁয়াযুক্ত বা ধোঁয়াবিহীন তামাক গ্রহণ করছেন। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারে আর্থিক ক্ষতির (অসুস্থতা চিকিৎসা এবং অকাল মৃত্যুর কারণে উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ বছরের ১৫৮.৬ বিলিয়ন টাকা। তামাক ব্যবহার কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাকপণ্যের মূল্য বাড়ানো। কার্যকরভাবে কর বাড়লে তামাকপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং সহজলভ্যতা হ্রাস পায়।
বক্তারা বাজেট বরাদ্দ ও কর ন্যায্যতা সমন্ধে বলেন যে, কেবল বাজেট বরাদ্দ দিলেই হবে না, নাগরিক প্রদত্ত করের অর্থে প্রণীত বাজেটের সুষ্ঠু ও গুণগত বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে। যাতে করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ অত্যাবশ্যকীয় সকল সেবাখাতসমূহে নাগরিকদের গুণগত সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। এই সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমেই নিশ্চিত হবে কর ন্যায্যতা।
বাজেট বাস্তবায়ন সমন্ধে বক্তারা বলেন, পরিকল্পিত বাজেট যথাসময়ে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করাটাই মূল চ্যালেঞ্জ। বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে গত অর্থবছরেই সবচেয়ে কম বাজেট বাস্তবায়িত হয়েছে। বাস্তবায়নের ঘাটতির মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে ৯৩ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়িত হয়েছিল। ক্রমান্বয়ে তা কমতে কমতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে নেমেছে সাড়ে ৭৮ শতাংশে এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়নের এই চিত্র ৭১% যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। বাজেট শতভাগ বাস্তবায়িত না হলে কাঙ্খিত সুফল পাওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’র (এসডিজি) কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণও ব্যাহত হবে।
সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ ও সুপ্র সচিবালয়ের কর্মীবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে সুপ্র’র সুনির্দিষ্ট সুপারিশগুলো হলো-
১. প্রত্যক্ষ কর নির্ভর বাজেট প্রণয়ন করতে হবে, করের বিপরীতে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে এবং কর প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে;
২. নিত্য প্রয়োজনীয় সেবা ও দ্রব্যের উপর মূসক বা ভ্যাট প্রত্যাহার করতে হবে;
৩. কর্পোরেটসহ সকল কর ফাঁকি রোধে কার্যকর ও দৃঢ় পদেক্ষপ গ্রহণ করাসহ বহুজাতিক কোম্পানী কর রেয়াত সুবিধার পুনঃমূল্যায়ণ করতে হবে;
৪. বাংলাদেশের বর্তমান তামাক কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল। তাই তামাক কর কাঠামো যুগোপযোগী করতে হবে;
৫. ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন, ২০১৩ এবং ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০১৫ এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং তামাকপণ্যের উপর আরোপিত স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ২% উন্নীত করতে হবে;
৬. শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ পথ বন্ধ করাসহ জাতীয় শিক্ষানীতি ’১০ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের কমপক্ষে ২০% বা জিডিপি’র ৬% বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে এবং শিক্ষানীতি অনুযায়ী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩০ নিশ্চিত করতে হবে;
৭. মৌলিক চাহিদা নয়,স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে এবং জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে কমপক্ষে জিডিপি’র ৩ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ১০ শতাংশ বরাদ্দ দেয়াসহ বাজেটের সুষম বন্টন এবং ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে;
৮. ভর্তুকি বৃদ্ধিসহ তৃণমূল কৃষকের চাহিদা ও দাবি বিশ্লেষণপূবর্ক অংশগ্রহণমূলক কৃষি বাজেট প্রণয়ন করতে হবে;
৯. কৃষিতে নারী শ্রমিকের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম-মজুরির ব্যবস্থার জন্য সুনিদ্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে;
১০. জলবায়ু পরিবর্তন জনিত অভিঘাতকে বিবেচনায় রেখে কৃষকদের জন্য শস্য বীমা চালু ও সমবায়ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা চালু করতে হবে;
১১. অতি দরিদ্র জনগোষ্টীর ডাটা ব্যাংক তৈরীসহ ‘টারগেটেড ইন্টারভেনশন’ (ঞধৎমবঃবফ রহঃবৎাবহঃরড়হ) নিতে হবে;
১২. প্রকৃত সুবিধাভোগী নির্বাচনে, সম্পদ ও সুবিধা প্রদানে জনঅংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জীবনচক্র ভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কার্যকর বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে;
১৩. জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাজেটে খাতভিত্তিক বিশেষ বরাদ্দ রাখাসহ বৈষম্য রোধে সমতাপূর্ণ প্রবৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করতে হবে।