জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। চার কারণে হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শাখাকে চার মাসের মধ্যে খালেদা জিয়ার করা আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত করতে পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল সোমবার দুপুরে খালেদা জিয়ার জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন।
এদিকে এই জামিন আদেশ স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আজ মঙ্গলবার আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, আপিল বিভাগে আবেদন করার কথা কারা কর্তপক্ষকে জানানো হবে।
এ ছাড়া কুমিল্লার একটি মামলায় খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করে গতকাল প্রডাকশন ওয়ারেন্ট জারি করেছেন স্থানীয় একটি আদালত। এসব কারণে তাঁর কারামুক্তি বিলম্বিত হতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
আদালতের জামিন আদেশ দুই দিনের জন্য স্থগিত রাখতে অ্যাটর্নি জেনারেলের তাৎক্ষণিক মৌখিক আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন আদালত।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, আদালত যেভাবে নির্দেশ দেবেন এবং আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আদেশের কপি কারাগারে গেলে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন। তিনি বলেন, এ আদেশের ফলে প্রমাণিত হয়েছে বিচার বিভাগের ওপর সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন তা প্রমাণিত হলো।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, জামিননামাসহ জামিন আদেশের কপি কারাগারে পৌঁছলে এবং তাঁকে আর কোনো মামলায় গ্রেপ্তার না দেখালে খালেদা জিয়ার মুক্তিতে বাধা নেই। তবে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, মঙ্গলবার খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, জামিন আদেশের কথা কমিশনকে জানানো হয়েছে। কমিশন সিদ্ধান্ত দেবে। এরপর আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করা হবে।
জামিনের চার কারণ : আদালত আদেশে বলেন, ক. সাজার পরিমাণ, খ. মামলার নথি (এলসিআর) পাওয়া গেলেও আপিল শুনানির জন্য পেপারবুক প্রস্তুত না হওয়ায় জামিন সুবিধা পেতে পারেন, গ. মামলার বিচার মোকাবেলা করা, নিয়মিত হাজির থাকা, নিম্ন আদালতে বিচারকালে জামিনে থাকা, জামিনের অপব্যবহার না করা এবং ঘ. বয়স ৭৩ বছর ও বয়সজনিত শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি জামিন পেতে পারেন।
কবে কারামুক্তি : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় জামিন পেলেও খালেদা জিয়া কবে কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন তা কেউই বলতে পারছেন না। নিয়ম অনুযায়ী, হাইকোর্টের জামিন আদেশের কপি প্রস্তুত হওয়ার পর কপিসহ বিচারিক আদালতে জামিননামা দাখিল করতে হবে। এরপর সেখান থেকে জামিননামা যাবে কারাগারে। সেটি পাওয়ার পর কারা কর্তৃপক্ষ তা যাচাই করবে। জামিন আদেশ সঠিক থাকলে, আপিল বিভাগ জামিন আদেশ স্থগিত না করলে এবং আর কোনো মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট বা গ্রেপ্তার দেখানো না হলে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে মুক্তি দেবে। কিন্তু জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জামিন আদেশ বহাল থাকলেও খালেদা জিয়ার শিগগিরই মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ এরই মধ্যে কুমিল্লার একটি মামলায় খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে। ওই মামলায় তাঁকে আগামী ২৮ মার্চ কুমিল্লার আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে সেই মামলায় এখন খালেদা জিয়াকে জামিন নিতে হবে। এ ছাড়া আরো চারটি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। সেসব মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হলে সে মামলাগুলোতেও খালেদা জিয়াকে জামিন নিতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট জামিন আদেশ বহাল রাখলেই শুধু মুক্তি পাবেন খালেদা জিয়া।
ওই সব গ্রেপ্তারি পরোয়ানা গুলশান থানায় ঝুলে আছে। গুলশান থানা সংশ্লিষ্ট আদালতকে যদি জানায় যে খালেদা জিয়া কারাগারে আছেন তবে আদালত হাজতি পরোয়ানা ইস্যু করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন না।
এদিকে খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর পর বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা ও গেটকো দুর্নীতি মামলায় তাঁকে আদালতে হাজির করার জন্য হাজিরা পরোয়ানা কারাগারে পাঠানো হয়। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে জামিননামা দাখিলের পর ওই সব হাজিরা পরোয়ানাও প্রত্যাহার করতে হবে। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের সংশ্লিষ্ট আদালতে আবেদন করতে হবে।
সংক্ষিপ্ত শুনানি : গতকাল আদেশের আগে কিছু সময়ের জন্য শুনানি হয়। খালেদা জিয়ার পক্ষে অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং দুদকের পক্ষে অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান শুনানি করেন।
গতকাল দুপুর সোয়া ২টায় দুই বিচারপতি এজলাসে বসার পর জামিন আবেদনের নথি বিচারকদের সামনে তুলে ধরেন বেঞ্চ অফিসার। ওই সময় জয়নুল আবেদীন বলেন, মামলার এলসিআর (নথি) এসেছে। তিনি আরো বলেন, ‘আগেই শুনানি সমাপ্ত হয়েছে। আজ আদেশের জন্য রয়েছে।’ তখন দুই বিচারপতি নথি দেখতে থাকেন। কিছু সময় পর আদালত বলেন, ‘আর কি কিছু বলার নেই?’ জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘নথি তো আপনাদের সামনেই রয়েছে। এখন আদেশের জন্য অপেক্ষা। যদি রাষ্ট্রপক্ষ কিছু বলে তাহলে আমরা জবাব দেব।’
এরপর আদালত অ্যাটর্নি জেনারেল ও দুদকের আইনজীবীর কাছে তাঁদের কিছু বলার আছে কি না জানতে চান। তখন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটা চাঞ্চল্যকর মামলা। আজই এ মামলার নথি এসেছে। তাই পর্যালোচনা করে আদেশ দেবেন।’ তিনি বলেন, ‘মামলাটি পরিষ্কার। এতিমের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিদেশ থেকে টাকা এসেছে। কিছু লোক সে টাকা তুলে নিয়ে গেছে। সব ডকুমেন্ট আছে। যেহেতু নিম্ন আদালতের নথি এসেছে সেহেতু আপিল শুনানির জন্য পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দেন।’
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘সাজা কম জামিনের কোনো যুক্তি হতে পারে না। তা ছাড়া অসুস্থতার সপক্ষে কোনো ডকুমেন্ট দেওয়া হয়নি। মাত্র আড়াই মাস ধরে কারাগারে রয়েছেন। এত তাড়াতাড়ি জামিন দেওয়া ঠিক হবে না।’ তিনি বলেন, এ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত তিনজন পলাতক। খালেদা জিয়া মূল আসামি হলেও তাঁর পাঁচ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। অন্যদের সাজা হয়েছে ১০ বছর।
ওই সময় আদালত তাঁর কাছে জানতে চান এ সাজায় তাঁরা সন্তুষ্ট কি না? জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘না। আমরা সব কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি।’ আদালত বলেন, ‘বাস্তবতা হলো, এখন পর্যন্ত আপনারা কোনো পদক্ষেপ নেননি। আদালতের সামনে এমন কিছু নেই।’
অ্যাটর্নি জেনারেল তখন সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের সাড়ে তিন বছর কারাগারে থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করলে আদালত বলেন, ‘তিনি তো ওই সময় শারীরিকভাবে ফিট ছিলেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে বিয়ে করেছেন। আল্লাহর রহমতে পুত্রসন্তান লাভ করেছেন।’
এরপর দুপুর ২টা ২৯ মিনিটে আদালত বলেন, ‘আমরা আদেশ দিচ্ছি। আশা করি আপনারা চুপ করে তা শুনবেন। কোনো শব্দ করবেন না।’ এরপর আদেশ দেন।
আদেশ শোনার সঙ্গে সঙ্গে আদালতকক্ষের বাইরে উপস্থিত লোকজন উল্লাস প্রকাশ করে। ওই সময় আদালতে আদেশ প্রদান করা থেমে যায়। জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন আদালতকে বলেন, ‘আমরা দেখছি। বন্ধ করছি।’ এরপর তাঁরা সবাইকে শান্ত থাকতে বলেন। সবাই চুপ করলে আদালত আপিল শুনানির জন্য পেপারবুক প্রস্তুত করার আদেশ দেন।
গতকাল আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী হিসেবে আরো ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, এ জে মোহাম্মদ আলী, আবদুর রেজাক খান, ব্যারিস্টার আমিনুল হক, নিতাই রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, সানাউল্লাহ মিয়া প্রমুখ। বিএনপির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাও উপস্থিত ছিলেন।
কুমিল্লার মামলায় প্রডাকশন ওয়ারেন্ট : কুমিল্লা থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ২০১৫ সালে যাত্রীবাহী নৈশ কোচে পেট্রলবোমা হামলায় আট যাত্রী হত্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে উপস্থাপন করার জন্য প্রডাকশন ওয়ারেন্ট জারি করেছেন স্থানীয় আদালত। কুমিল্লার ৫ নম্বর আমলি আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক মো. মুস্তাইন বিল্লা গতকাল এ পরোয়ানা জারি করেন। বিকেলে পরোয়ানাটি কুমিল্লা কারাগারে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আদালত পরিদর্শক সুব্রত ব্যানার্জি। মামলার পরবর্তী ধার্য দিন রয়েছে ২৮ মার্চ। এর আগে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ২৪ এপ্রিলের মধ্যে তামিল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন একই আদালত।
সুব্রত ব্যানার্জি জানান, ঢাকার গুলশান থানার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিলকারী কর্মকর্তা কুমিল্লার ৫ নম্বর আমলি আদালতে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করেন।