নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস নভেম্বর ১৯-২১, ২০১৮ ওয়াই-ওয়াই (ইউনূস এন্ড ইউ) এর ক্যাম্পাস পরিদর্শন উপলক্ষ্যে ফ্রান্সের প্যারিস ও লিল নগরী ভ্রমণ করেন। ফ্রান্সের অর্থনৈতিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস পরিকল্পনায় সামাজিক ব্যবসার অগ্রগতি বিষয়ে ওয়াই-ওয়াই এর আগ্রহের প্রেক্ষিতে তিনি সেখানে গমন করেন।
প্যারিসে প্রফেসর ইউনূস ল্য ক্যানঅ-তে অনুষ্ঠিত প্যারিস ২০২৪ অলিম্পিকের স্ট্র্যাটেজিক কমিটির সভায় যোগ দেন। উল্লেখ্য যে, এই কমিটিকে প্যারিসে অনুষ্ঠেয় ২০২৪ অলিম্পিকে সামাজিক ব্যবসার উপাদান নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অলিম্পিক সাংগঠনিক কমিটির প্রধান, ফ্রান্সের চার জন জুনিয়র মন্ত্রী, প্যারিসের আঞ্চলিক মেয়রগণ এবং ফ্রান্সের সিভিল সোসাইট নেতৃবৃন্দ এই সভায় অংশ নেন। প্রফেসর ইউনূস আগামী ছয় মাসের মধ্যে এই সামাজিক ব্যবসা অলিম্পিকের মূল বিষয়গুলো চ‚ড়ান্ত করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন যাতে ২০২৪ সালের আগেই এজন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এবং অনুষ্ঠানের যাবতীয় আয়োজন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। সভায় উপস্থিত সরকারী প্রতিনিধি, অ্যাথলেট ও সিভিল সোসাইটি নেতারা এই অসাধারণ ও ভিন্নধর্মী অলিম্পিক থেকে তাঁদের প্রত্যাশা তুলে ধরেন। আগামী বসন্তকালে অনুষ্ঠেয় কমিটির পরবর্তী সভার আগেই একটি বিস্তারিত কনসেপ্ট ডকুমেন্ট প্রস্তুত ও বিলি করার ব্যাপারে কমিটি একমত হয়।
প্রফেসর ইউনূসের ওয়াই-ওয়াই ক্যাম্পাস ট্যুর শুরু হয় লিল-এ অবস্থিত ইউনিভার্সিটি ক্যাথোলিক দ্য লিল পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রেসিডেন্ট-রেক্টর পিয়েরে গিয়োরিনি তাঁকে স্বাগত জানান। ইউনিভার্সিটি মিডিয়া ল্যাবে ফ্রেডেরিক ক্লেয়ে প্রফেসর ইউনূসের একটি সাক্ষাৎকার নেন। এছাড়াও প্রফেসর ইউনূস বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্টারপ্রাইজ এন্ড স্যোশাল ইমপ্যাক্ট বিজনেস চেয়ারের প্রতিনিধির সাথে বৈঠক করেন।
প্রথম ওয়াই-ওয়াই ক্যাম্পাস ট্যুর কনফারেন্সে প্রফেসর ইউনূস ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন এবং তাঁর সর্বশেষ বই অ ডড়ৎষফ ড়ভ ঞযৎবব তবৎড়বং -এর আলোকে নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর বার্তা তুলে ধরেন। সামাজিক ব্যবসায়ে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ বক্তা, ছাত্র ও সামাজিক ব্যবসা কর্মীদের একটি প্যানেল ওয়াই-ওয়াই ক্যাম্পাস ট্যুর কনফারেন্সগুলোতে উপস্থিত ছিলেন।
লিল এর পর প্রফেসর ইউনূস তাঁর দ্বিতীয় ওয়াই-ওয়াই ক্যাম্পাস ট্যুরে প্যারিসের সায়েন্স-পো বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন ও অ্যাকাডেমিক টিম। উল্লেখ্য যে, সায়েন্স-পো বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ফ্রান্সের অন্যতম বিখ্যাত ও প্রভাবশালী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রফেসর ইউনূস সেখানে “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য” কোর্সের ছাত্রদের সাথে বৈঠক করেন।
এছাড়াও “ভয়েস ফর চেঞ্জ ডকুমেন্টারী”র জন্য প্রফেসর ইউনূসের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। এই ডকুমেন্টারীগুলোতে চার জন টিনএজার উন্নয়ন বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেয়। এই ফিল্মগুলোতে তরুণ টিনএজারদের চোখে তাদের নিজ প্রজন্মের বিভিন্ন সমস্যা ও সেগুলোর প্রতিকারের উপায় তুলে ধরা হয়।
তাঁর সফরের শেষ দিন ২০ নভেম্বর ২০১৮ প্রফেসর ইউনূস সরবন ইউনিভার্সিটি বিজনেস স্কুলের সাথে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার চালুর লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন। সরবনে প্রতিষ্ঠিত এই ইউনূস সেন্টারটি ফ্রান্সের ১০ম এবং বিশ্বব্যাপী ৬৫তম ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার। আইএই দ্য প্যারিস সরবন গ্র্যাজুয়েট বিজনেস স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৬ সালে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি ফ্রান্সে ব্যবসা প্রশাসন শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে আসছে।
তাঁর ফ্রান্স সফরকালে প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ক্রেডিট এগ্রিকোল মাইক্রোফাইনান্স ফাউন্ডেশনের ১০ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে মূল বক্তা হিসেবে অংশ দেন। উল্লেখ্য যে, বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসাকে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ইউরোপের নেতৃস্থানীয় ব্যাংক ক্রেডিট এগ্রিকোল ও বাংলাদেশের গ্রামীণ ট্রাস্ট কর্তৃক ১০ বছর পূর্বে যৌথভাবে এই ফাউন্ডেশনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। দশম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যোগদানকারী বিশিষ্ট অভ্যাগতদের মধ্যে আরো ছিলেন লুক্সেমবার্গের গ্র্যান্ড ডাচেস মারিয়া থেরেসা এবং ক্রেডিট এগ্রিকোল ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিন স্যান্ডার।
২১ নভেম্বর বুধবার ২০১৮ ইএসসিপি (ইকোল সুপিরিয়র দ্য কমার্স দ্য প্যারিস) ইউরোপ পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে প্রফেসর ইউনূসের ওয়াই-ওয়াই ক্যাম্পাস ট্যুর সমাপ্ত হয়। ইএসসিপি ইউরোপ বিশ্বের প্রাচীনতম বিজনেস স্কুল যার ক্যাম্পাস রয়েছে প্যারিস, বার্লিন, লন্ডন, মাদ্রিদ, তুরিন এবং ওয়ারশ-তে। ইএসসিপি ইউরোপ ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি যাকে এইচইসি প্যারিস ও ইএসএসইসি বিজনেস স্কুলের সাথে প্যারিসের সেরা ত্রয়ী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রফেসর ইউনূস সেখানে হল ভর্তি ছাত্র ও শিক্ষকদের একটি সমাবেশে ভাষণ দেন। তাঁর বক্তব্যে তিনি এই যুক্তি তুলে ধরেন যে, বিজনেস স্কুলগুলোর উদ্দেশ্য শুধু বাজারে শেয়ারহোল্ডার ও কোম্পানীগুলোর মুনাফা সর্বোচ্চ করার লক্ষ্যে মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে কর্মচারী হিসেবে তরুণদের প্রশিক্ষিত করা লক্ষ্য হতে পারে না, বরং তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত সম্পদ কেন্দ্রীকরণসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জরুরী সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলতে ও সেগুলো পরিচালনা করতে ছাত্রদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়া। সম্পদ কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার হাতিয়ার হিসেবে ছাত্রদেরকে তৈরী করার পরিবর্তে তাদেরকে বরং এই প্রক্রিয়াকে উল্টে দিয়ে পৃথিবীর সম্পদ সুষমভাবে সকলের মধ্যে বন্টনের সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলা উচিত।