বিমল দে’র অনবদ্য পরিবেশনার মাধ্যমে উদীচী’র তিন দিনব্যাপী সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব

0
214
বিমল দে’র অনবদ্য পরিবেশনার মাধ্যমে উদীচী’র তিন দিনব্যাপী সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব

বিমল দে’র অনবদ্য পরিবেশনার মাধ্যমে
উদীচী’র তিন দিনব্যাপী সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব সমাপ্ত

কিংবদন্তি হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, নিবারণ পণ্ডিত, বিনয় রায়, সুরেশ বিশ্বাস, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, বিপুল চক্রবর্তী, আলফ্রেড হেইসসহ গণসঙ্গীতের দিকপালদের রচিত ও সুরারোপিত অসাধারণ গানের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত তিন দিনব্যাপী “সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা-২০১৮”। ২৮ মার্চ শুরু হওয়া এ উৎসব চলে ৩০ মার্চ পর্যন্ত। ৩০ মার্চ ছিল উৎসবের তৃতীয় ও শেষ দিন। এদিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিশু একাডেমী মিলনায়তনে আয়োজিত হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী ও এবারের উৎসবের আমন্ত্রিত অতিথি বিমল দে’র পরিবেশনা। তাঁর কণ্ঠেই প্রাণ পায় কিংবদন্তি গণসঙ্গীত রচয়িতাদের অনবদ্য একেকটি সৃষ্টি।

অনুষ্ঠানের শুরুতে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত সংগঠন ‘সঙ্গীত ভবন’। তাদেরকে উদীচী’র পক্ষ থেকে ফুল ও উদীচী’র প্রকাশনা দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। এরপরই মঞ্চে আহবান জানানো হয় বিমল দে’কে। তাঁকে স্বাগত জানানোর পর তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী পাঠ করা হয়। আমন্ত্রিত শিল্পীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন। এরপর একক সঙ্গীত আয়োজন দিয়ে উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করেন বিমল দে।

গণসঙ্গীতের কিংবদন্তি পুরুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচিত ‘কাস্তেটারে দিও জোরে’ গানটির মাধ্যমে নিজের পরিবেশনা শুরু করেন বিমল দে। এরপর একে একে তিনি পরিবেশন করেন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘আজাদী হয়নি আজো’, ‘বাজে ক্ষুব্ধ ঈশানী’, ‘আমরা তো ভুলি নাই’, ‘তোরা বল সখী বল’, ‘শঙ্খচিলের গান’, ‘বাঁচবো বাঁচবো’, ‘এই সমাধিতলে’; বিষ্ণু দে রচিত ‘রুশ দেশের কমরেড’, নিবারণ পণ্ডিতের ‘আরে ওরে দেশবাসী’, সলিল চৌধুরীর ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’, সুরেশ বিশ্বাসের ‘শত শহীদের রক্তে’, সমরেশ বন্দোপাধ্যায়ের ‘চারটি নদীর গল্প’, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘একদিন মাকে দিয়েছিলাম’, পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘শ্লোগান দিতে গিয়ে’, আলফ্রেড হেইস-এর ‘জো হিল’, বিপুল চক্রবর্তীর ‘আন্ধারে কে গো’-এর মতো অনবদ্য একেকটি গান। তাঁর অনবদ্য গায়নশৈলী ও অসাধারণ উপস্থাপনা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন মিলনায়তনে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার উত্তরপাড়ায় ১৯৫৪ সালে জন্ম নেয়া বিমল দে ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান। তাঁর বড়দা ছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরীর মতো দিকপালদের পরিচালিত গানের দলের সদস্য। মেজদা ছিলেন সেতার বাদক অন্নপূর্ণা দেবীর শিষ্য। সঙ্গীতের পরিবেশে বেড়ে ওঠা বিমল দে’র সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয় তাঁর বড়দার কাছে। ১৯৬৯ সালে স্কুলজীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। রাজনীতির পাশাপাশি কণ্ঠকে হাতিয়ার করে দিন বদলের সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন বিমল দে। বাংলা গণসঙ্গীত ও লোকসঙ্গীতের একজন শিল্পী হিসেবে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠান করেছেন এবং এখনও তা অব্যাহত রেখেছেন। বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার পক্ষ থেকে তিনি অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন।

গত ২৮ মার্চ বুধবার বিকাল ৪টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উৎসব উদ্বোধন করেন উদীচীর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও সাবেক সভাপতি, গণসঙ্গীত শিল্পী গোলাম মোহাম্মদ ইদু। উদ্বোধনী পর্বে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন গোলাম মোহাম্মদ ইদু আর সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদ। এরপর পরিবেশিত হয় গণসঙ্গীতের কিংবদন্তি পুরুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের অমর সৃষ্টি “শঙ্খচিল” গানের নৃত্যরুপ। এ ভূখণ্ডের প্রথিতযশা গণসঙ্গীতশিল্পীদের জীবন ও কর্ম নিয়ে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ প্রকাশিত সংকলন ‘গণসঙ্গীতের গণনায়কেরা’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। গণসঙ্গীতের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে অধিকার বোধ জাগ্রত করা এবং তাদেরকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ায় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন এমন ১৭ জন গুণী মানুষের জীবন ও কর্ম নিয়ে লেখা প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে এ সংকলনে। এছাড়া, গণসঙ্গীতে অবদান রাখার জন্য সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসবে সম্মাননা জানানো হয় প্রায় অর্ধশত গুণীজনকে।

গত ২৯ মার্চ বৃহস্পতিবার ছিল উৎসবের দ্বিতীয় দিন। এদিন বিকাল ৫টায় শুরু হয় ‘উদীচীর সুবর্ণজয়ন্তী ও গণসঙ্গীত’ বিষয়ক আলোচনা পর্ব। এরপর এবারের জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে সনদ ও সম্মাননা স্মারক তুলে দেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। এবারের প্রতিযোগিতায় ‘ক’ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে প্রজ্ঞা তালুকদার, দ্বিতীয় হয়েছে সাফায়েত আলম চৌধুরী আর তৃতীয় হয়েছে নবনীতা ঘোষ শ্রেয়া। ‘খ’ বিভাগে প্রথম হয়েছে সাবরিনা জাহান শোভা, দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে জান্নাতুল ফেরদৌস এবং তৃতীয় হয়েছে ওয়াজিহা তাসনিম। ‘গ’ বিভাগে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে অরুণ চন্দ্র বর্মণ, দ্বিতীয় হয়েছে কমল ঘোষ এবং তৃতীয় স্থান পেয়েছে চন্দ্রিমা ভৌমিক রাত্রী। আর দলীয় অর্থাৎ ‘ঘ’ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নারায়ণগঞ্জের যোদ্ধা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন, দ্বিতীয় হয়েছে উদীচী বগুড়া জেলা সংসদ আর তৃতীয় স্থান পেয়েছে উদীচী যশোর জেলা সংসদের শিল্পীরা।

উদীচী রাজনৈতিক অঙ্গীকারসম্পন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। চারণ শিল্পীদের মতো কন্ঠে গণসঙ্গীত নিয়ে, মানুষের মুক্তির জন্য, ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সুরের মাধুর্য্যে অসুর নিধনের ব্রত উদীচীর। এ বছর উদীচী প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। দেশের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে গণসঙ্গীতকে ছড়িয়ে দেয়া, গণসঙ্গীতের প্রচার ও প্রসার এবং গণসঙ্গীতকে সঙ্গীতের একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উদীচী’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সত্যেন সেনের জন্মদিবস উপলক্ষে ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর এই উৎসব আয়োজন করছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। এবার নবমবারের মতো আয়োজিত হচ্ছে এ উৎসব ও প্রতিযোগিতা। এবারের উৎসবের শ্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে “ঐক্যের সুরে বাঁধো সাম্যের গান”। উদীচী মনে করে, এ উৎসবের মাধ্যমে গণসঙ্গীতের যেমন প্রসার ঘটবে, শিল্পীরা উদ্বুদ্ধ হবে এই গান গাইতে, তেমনি গণমানুষের শোষণ বঞ্চনা, পাওয়া না পাওয়া সুখ দুঃখ সুরের ললিত বাণী হয়ে ব্যাপ্ত হবে চারিদিকে।