বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সময় নিয়ন্ত্রণের প্রতিবাদে শুক্রবার দেশব্যাপী উদীচীর প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ
পহেলা বৈশাখ বাংলা ও বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সময় নিয়ন্ত্রণ এবং মুখোশ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিবাদে আগামী ১৩ এপ্রিল শুক্রবার দেশব্যাপী প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। গত ১১ এপ্রিল বুধবার সকাল ১১টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির গোলটেবিল মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদ-এর সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করবেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান এ দেশে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল, সর্বত্র তথাকথিত ‘মুসলমানীকরণের’ কর্মসূচি নিয়ে তারা বন্ধ করতে চেয়েছিল সহস্র্র বছরের বাঙালির আচার, ঐতিহ্য ও গৌরবের সংস্কৃতিকে। এ মাটি থেকে উৎসারিত, মাটিবর্তী মানুষের শ্রম ও ঘামের অতুল নিদর্শন বাঙলা নববর্ষ এবং চৈত্র সংক্রান্তি কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পহেলা বৈশাখের উৎসবকে তারা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে ‘পহেলা বৈশাখ’সহ নানা সাংস্কৃতিক উৎসব-আচারকে তারা ‘হিন্দুয়ানী’ আখ্যা দিয়েছিল। তারা ভেবেছিল- সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তুলে ব্যাপক মুসলমান জনগোষ্ঠীর সমর্থন পাবে। কিন্তু এ দেশের উদার মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা অন্য ধর্ম ও আচার অবলম্বী মানুষ ধর্মীয় পরিচয়কে নয় জাতি পরিচয়কেই উর্ধ্বে তুলে ধরেছিল বারবার। ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে এই বাংলা নামে ব-দ্বীপটিতে বসবাসকারী মানুষগুলো ধর্মে বর্ণে বিভেদকে কখনোই পাত্তা দেয়নি। পরস্পরের পাশে থেকে সুখ দুঃখকে ভাগ করে নিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, সে পাকিস্তানের সাম্প্রদয়িক বর্বর নীতির ভুত ফিরে আসছে আবার। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে এসেও সেই পুরনো অপশক্তিকে মোকাবেলা করার জন্য আমাদের লড়াই চালাতে হবে সেটা আমরা ভাবতেও পারিনি। কিন্তু এ দেশের শাসনযন্ত্র বারবারই করায়ত্ব হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনাবিরোধী শক্তির হাতে। তাদের হাতেই পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি ও ধর্মান্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠী। ফলে এখনো মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ আমরা পাইনি। বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতি, হাজার বছরের সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোর বিরুদ্ধে বারবার বিষোদ্গার ও অপপ্রচার চালিয়ে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আমাদের সংস্কৃতিশূন্য অমানবিক জাতিতে রূপান্তর করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। সম্প্রতি পহেলা বৈশাখের মতো বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত লৌকিক উৎসবের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। তারা প্রকাশ্যে আমাদের সমৃদ্ধ এ সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এমনকি তারা ২০০১ সালে রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বর্বর বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষকে। তারা ভেবেছিল এভাবেই প্রাণের উৎসব থেকে বাঙালিকে বিচ্যুত করতে পারবে। কিন্তু তারা আজ পরাজিত। এতবড় হামলার পরও বাঙালি বহুগুণ উৎসাহে বর্ষবরণ উৎসবে মিলিত হয় প্রতিবছর। কোনো রক্তচক্ষু, হত্যা, হামলার ভয় বাঙালিকে উৎসববিমুখ করতে পারেনি। এরপরও পহেলা বৈশাখের এ আয়োজনকে বন্ধ করতে থেমে নেই ষড়যন্ত্র। কারণ এ আয়োজন মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর জন্য ‘আতঙ্কের’। কেননা এ উৎসবে নিহিত রয়েছে বাঙালির ঐক্য, সকল সম্প্রদায়ের অভাবিত সম্মিলন এবং সংগ্রামের প্রেরণা।
লিখিত বক্তব্যে জামসেদ আনোয়ার তপন বলেন, প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ বাংলা বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কোটি মানুষ উৎসবে মিলিত হয়। রাজপথ থেকে অলিগলি মেতে উঠে নব আনন্দে। ফলে পহেলা বৈশাখের আয়োজনকে যেকোনোভাবে কালিমালিপ্ত করতে উদ্যত অপশক্তি। সম্প্রতি এ শক্তিটি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা হামলার ভয় দেখিয়ে আবারো বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে রদ করতে চায়। নিরাপত্তার অজুহাতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও পহেলা বৈশাখের উৎসবের সময় সঙ্কোচনের নীতি গ্রহণ করেছে। যেখানে মৌলবাদী গোষ্ঠীর হামলার হুমকিকে চ্যালেঞ্জ করে উৎসবকে অবারিত করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল সেখানে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপশক্তির হুমকিতে জড়োসড়ো। তারা বিকেল ৫টা র্পন্ত ে পহেলা বৈশাখের উৎসবের সময় বেঁধে দিয়ে প্রকারান্তরে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। যা মোটেই কাম্য নয়। সাধারণ মানুষ যেখানে এ উৎসবে স্বতঃস্ফূর্ত ও নির্ভিক সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অত্যুৎসাহী ভূমিকা এবং সরকারের ‘ভয়’ আমাদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। তাই সরকারের এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া যায় না।
উদীচী’র সাধারণ সম্পাদক অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান। পহেলা বৈশাখ ও বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে হুমকি দাতাদের বিচারের আওতায় আনার জোর দাবী জানাচ্ছি। এছাড়া, বৈশাখ উদযাপনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা বিষয়ক যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা সার্বিকভাবে উৎসবের বৈচিত্র্যকে খর্ব করবে, তাই এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। তিনি বলেন, উদীচী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সকল অপশক্তি রুখতে হবে। পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণের আয়োজনে জনগণ যেভাবে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো রাস্তায় নামে তার প্রতি দায়িত্বশীল ও সশ্রদ্ধ হবে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
তিনি বলেন, বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সময় সংকোচনের সরকারি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর উদ্যোগে আগামী ১৩ এপ্রিল বিকেল ৪টায় দেশব্যাপী একযোগে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। দেশে ও দেশের বাইরে অবস্থিত উদীচী’র সাড়ে তিন শতাধিক শাখা সংসদের উদ্যোগে একযোগে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ আয়োজন করা হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে ১৩ এপ্রিল শুক্রবার বিকাল ৪টায় শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এ কর্মসূচি আয়োজিত হবে। দেশব্যাপী এ কর্মসূচিতে উদীচী ছাড়াও দেশের অন্যান্য প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক ভাবধারার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যোগ দেবে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এ কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার আহবান জানিয়েছে উদীচী। তিনি আশা করেন, সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এবং এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেবে।
সংবাদ সম্মেলনে উদীচী’র সাবেক সভাপতি কামাল লোহানী অভিযোগ করেন, হেফাজতে ইসলামের প্রেসক্রিপশন মেনে সময় সঙ্কোচনের এ সিদ্ধান্ত ঘোষণার মাধ্যমে সরকার সাম্পদায়িক অপশক্তির হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য শংকর সাওজাল বলেন, কোন উৎসবই নিরাপত্তা প্রহরীর ঘেরাটোপে হয় না। নিরাপত্তা দিয়ে শৃঙ্খলিত করা হলে তা মানা হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, যে সংস্কৃতির জন্য আমাদের যুদ্ধ তাকে অবরুদ্ধ করে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে। সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান, সহ-সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে, ইকবালুল হক খানসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।