আজ ২৯ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার, বিকাল ৪টায় ধানমিন্ডির ১৫/এ এর ৫৮ নং বাড়ির দৃক গ্যালারিতে রানা প্লাজা ধস ও হাজারো প্রাণ ও স্বপ্ন হত্যার ৫ বছর (২৪ এপ্রিল) স্মরণে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির পক্ষ থেকে ‘‘মৃতদের স্মরণ করো জীবিতদের জন্য লড়াই করো’’ এই শ্লোগান নিয়ে ‘স্মৃতি কাঁথা ও কথা’ এর ২য় প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রদর্শনীটি পরিকল্পনা ও কিউরেটিং করেছেন যৌথভাবে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান ও আলোকচিত্রী তাসলিমা আখ্তার ও আমেরিকান অ্যাক্টিভিস্ট, ইতিহাসবীদ এবং কাঁথা শিল্পী রবিন বারসন।
দুই দিন ব্যাপী ’স্মৃতি কাঁথা ও কথা ’ এর ২য় দফা প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেন নিহত আঁখির মা নাছিমা আক্তার। পুরো আয়োজন নিয়ে কথা বলেন নিখোঁজ শান্তনার বোন সেলিনা। এছাড়া আরো কথা বলেন, গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখ্তার, মানবাধিকার কর্মী হামিদা হোসেন, আলোকচিত্রী শহীদুল আলম, ইউনিভার্সিটি কলেজ এবং লন্ডনের অধ্যাপক বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার পেনি ও অধ্যাপক আহমেদ কামাল। শিল্পী রবিন বারসন এর লিখিত শুভেচ্ছা বার্তা পাঠ করা হয়। এছাড়া প্রদর্শনীতে উপস্থিত হন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণফেরামের সভাপতি বিশিষ্ট আইনজীবি কামাল হোসেন, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। উল্লেখ্য রানা প্লাজার সামনে ১ম প্রদর্শনীটি ২০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে সকলের অনুরোধে ২৯ ও ৩০ তারিখ দৃক গ্যালারিতে আয়োজন করা হয়ে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, স্মৃতি কাঁথা ও কথা প্রদর্শনীটি ২য় আয়োজন এর মধ্য দিয়ে সচেতন নাগরিকদের কাছে ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজার ভয়াবহতাকে না ভুলে সোচ্চার হবার আহŸান করা হয়েছে। তাঁরা বলেন, ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সালে রানা প্লাজায় কাঠামোগত হত্যাকাÐে ১১৭৫ জনেরও বেশি শ্রমিক প্রাণ হারান। সারা দুনিয়ার কারখানার ইতিহাসে এই ঘটনা বিরল হলেও এখন পর্যন্ত শাস্তি হয়নি সোহেল রানাসহ দোষীদের। তাই এই স্মৃতি কাঁথা প্রদর্শনীর মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের আইন বদল এবং রানা প্লাজা-তাজরীনের পুণরাবৃত্তি বন্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহŸান জানাই।
বক্তারা আরো বলেন, ৫ বছরে এখনো শাস্তি হয়নি দোষীদের আর অন্যদিকে সস্তা মজুর হিসাবে বর্তমান বাজার দরে পোশাক শ্রমিকের বেহাল জীবন। ৫৩০০ টাকার বেতনে বেঁচে থাকা দায়। শ্রমিকরা দাবি তুলেছে বেসিক মজুরি ১০,০০০ এবং ১৬,০০০ টাকা মোট মজুরি করার। এই দাবির সাথে একাত্ম হয়েই এবারের ২৪ এপ্রিলে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি আওয়াজ তুলেছে ‘মৃৃতদের স্মরণ করো জীবিতদের জন্য লড়াই করো’।
উল্লেখ্য, শ্রমিকদের ছবি কাপড়ে বসিয়ে বাংলাদেশের ঐতিহ্য অনুযায়ী নানা অঞ্চলের কাঁথা সেলাইয়ের ফোঁড় দিয়ে নিহত শ্রমিক পরিবারের সদস্যরাই তৈরী করেছেন ‘স্মৃতি কাঁথা’। একই সাথে নিজ হাতে পরিবারের নিহত সদস্যদের নিয়ে ছোট ছোট রুমালে লিখেছেন নিজেদের মনের নানা কথা। এসব কথায় লুকিয়ে আছে হারানো আপজনের জন্য আকুতি। পরিবারের নারী সদস্যরাই সেলাই করেছেন। কেউ নিহতের মা, কেউ বোন, কেউ মেয়ে, স্ত্রী, চাচী বা পরম আত্মীয় বা রানা প্লাজার আহত কোন নারী শ্রমিক।
মোট ১৫টি নিহত নিখোঁজ পরিরবারের নারী সদস্যরা এই কাজ এ অংশ নিয়েছেন। এরা হলেন নিহত শান্তনার বড় বোন সেলিনা আক্তার, নিহত ফজলে রাব্বীর মা রাহেলা খাতুন, নিখোঁজ সমাপ্তি রাণী দাস ও নির্মলা রাণী দাসের আত্মীয় আহত শ্রমিক সুমিত্রা রাণী, নিখোঁজ বিউটি বেগমের মেয়ে ফারজানা, নিহত শিরীন বেগমের মেয়ে মুক্তা, নিহত ই¯্রাফীলের স্ত্রী চায়না বেগম, নিহত সনজিৎ দাসের মা শুন্যবালা দাস, নিহত পলি আক্তারের মা শাহানা, নিহত খালেদার মা আয়েশা, নিহত মো. শহীদুলের স্ত্রী খাদিজা, নিহত আঁখি আক্তারের মা নাছিমা। এছাড়া অন্যান্য শ্রমিক পরিবার এবং আহত নারী শ্রমিকরাও এই প্রদর্শনীর কাজে অংশ নিয়েছেন।
উল্লেখ্য, রবিন বারসন ২০১১ সালে নিউইয়র্ক শহরের ট্রায়াঙ্গাল সোয়েটার কারখানার ১০০ বছর পূর্তিতে ঐ ঘটনায় নিহতদের ছবি সংগ্রহ করেন এবং সে ছবি দিয়ে শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে কাঁথা তৈরী করে প্রদর্শনী করেন। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে রানা প্লাজা ও তাজরীনের নিহতদের নিয়ে স্মৃতি কাঁথা তৈরী করেন ২০১৪ সালে। আলোকচিত্রী তাসলিমা আখ্তার দীর্ঘ ১০ বছর ধরে গার্মেন্ট শ্রমিকদের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠক হিসাবে। আর ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে তুলেছেন শ্রমিকদের জীবন সংগ্রাম নিয়ে ছবি। তাসলিমা আখতারের তোলা রানা প্লাজায় নিহত দুজনের ছবি ‘ফাইনাল এমব্রেস’ নামে পরিচিত। এই ছবি রানা প্লাজার ধস ও শ্রমিক হত্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকি দলিল হয়ে শ্রমিক অধিকার আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।