এত শোক সইবে কিভাবে মাহি
নিহত পাইলট আবিদের স্ত্রীর মৃত্যুর খবর সংগ্রহ করার জন্য হাসপাতালে সংবাদকর্মীদের ভিড়। তাঁদের বেশি আগ্রহ ১৫ বছরের কিশোর তানজিব বিন সুলতান মাহিকে নিয়ে। ছেলেটি কোথায়, কী করছে? তবে সব আগ্রহ যেন নিস্তব্ধতায় ম্লান। কারো মুখে কোনো কথা নেই। কান্নার ভাষাও যেন হারিয়ে গেছে স্বজনদের। ভিড়ের মধ্যে মাঝেমধ্যে খুবই নিচু গলায় কুঁকড়ে ওঠার শব্দ। এক ফাঁকে স্বজনদের বেষ্টনীতে দেখা গেল মাহিকে। উদ্দেশ্যহীন, ছলছল চোখ। স্বজনরাও যেন খুঁজে পাচ্ছে না ভাষা। দেড় সপ্তাহের ব্যবধানে যে ছেলে বাবা ও মাকে হারাল, তাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে?
সাংবাদিকদের অনুরোধে অসহায়ের মতো মাহির চাচা ড. খুরশিদ মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের কিছু বলার ভাষা নেই। আমাদের একটু একা থাকতে দিন। ছেলেটাকে (মাহি) নিয়ে কী করব বুঝতে পারছি না।’
জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে চিকিৎসকরা আফসানা খানমকে মৃত ঘোষণা করেন। সন্ধ্যায় বনানী কবরস্থানে স্বামী আবিদ সুলতানের পাশে শায়িত হন আফসানা খানম। স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা আবিদ–আফসানার কিশোর ছেলে মাহির সুস্থতা নিয়েই এখন বেশি চিন্তিত। একজন স্বজন কালের কণ্ঠকে জানান, দুই দিন আগেই বাবার লাশ দেখেছে। এখন মায়ের লাশ দেখলে ছেলেটা যদি সইতে না পারে, তাই তাঁরা তাকে সারাক্ষণ আগলে রাখছেন। শেষে জানাজার আগে একবার মাহিকে মায়ের লাশ দেখানো হয়। জানা যায়, দিনভর স্বজনরা পাথরচাপা কষ্টের মধ্যে মাহিকে আগলে ছিল। স্বজনরা জানায়, দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটিও ঘটেছে আবিদের চোখের সামনে। এ কারণেই এত সাবধানী তারা।
আবিদের ভাই ড. খুরশিদ মাহমুদ, আফসানার চাচা ইয়াদ আলী ও ফুফাতো ভাই খন্দকার রেজাউল করিম জানান, দুর্ঘটনার পর প্রথমে আবিদ জীবিত বলে খবর পান আফসানা। পরদিন মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি চুপসে যান। সেভাবে কান্নাকাটি করেননি। ১৭ মার্চ তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। এ ঘটনাও হয় ছেলে মাহির সামনে। মায়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল সে। সকালে উঠে দেখে মা নড়ছে না। পরে চিৎকার করে স্বজনদের ডাকে মাহি। আফসানাকে প্রথমে উত্তরার একটি হাসপাতালে এবং পরে জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালটির যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুই দিন ধরেই তাঁর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছিল। ব্রেন, কিডনি, লিভার বিকল হয়ে পড়ে। সর্বশেষ আজ (গতকাল) সকাল ৯টায় তিনি মারা যান।’
সেখানে দুই দফায় অস্ত্রোপচারের পর তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। চিকিৎসকরা আশার কথা বলেননি শুরু থেকেই। গত ১৯ মার্চ সংকটাপন্ন আফসানাকে রেখেই পাইলট আবিদের লাশ দাফন করে মাহিসহ স্বজনরা।
স্বজনরা আরো বলছে, স্বামীর মৃত্যুর পর আফসানাকে কান্নাকাটি করতে দেখা যায়নি। মাহিও একইভাবে আছে। এতে তারা ভয় পাচ্ছে। কাঁদলে মন হালকা হতো। এখন ছেলেকে নিয়েই তাদের যত চিন্তা।
আফসানার ফুফাতো ভাই খন্দকার রেজাউল করিম বলেন, ‘বাবার এমন মৃত্যু, চোখের সামনে মায়ের লাশ দেখলে ছেলেটা যদি সইতে না পারে। এ কারণে ওকে আমরা লাশ দেখাচ্ছি না। মাহিও চাইছে না।’ পরে জানাজার আগে একবার মায়ের মুখ মাহিকে দেখতে দেওয়া হয়। তখন সে কুঁকড়ে কেঁদে ওঠে। একজন স্বজন বলেন, গত ১৯ মার্চ বাবার দাফন সম্পন্ন করে এলো মাত্র। তিন দিন যেতে না যেতেই আবার মায়ের মৃত্যু, তাঁর দাফন সম্পন্ন করতে হবে। এ শোক কিভাবে সইবে মাহি? ইংরেজি মাধ্যম ‘ও’ লেভেলের ছাত্র মাহির কয়েকজন সহপাঠীকে বলতে দেখা যায়, মাহি কেমন যেন নীরব হয়ে গেছে, কান্নাকাটি করছে না, একদম চুপ হয়ে গেছে।
গতকাল দুপুর ২টার দিকে স্বজনরা আফসানার লাশ উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে স্বজনদের কান্নার রোল পড়ে যায়। গাউসুল আজম জামে মসজিদে আসরের নামাজের পর তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যা ৭টায় বনানীর সামরিক কবরস্থানে ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে আফসানাকে। এ সময় আবিদ–আফসানার একমাত্র সন্তান মাহি ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ স্থানীয় বাসিন্দারা উপস্থিত ছিল। গত ১২ মার্চ নেপালের কাঠমাণ্ডুতে ইউএস–বাংলার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহত হন পাইলট আবিদ সুলতানসহ ২৬ জন বাংলাদেশি।